ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক,২১ মার্চ ২০২৫ইং (ডিজিটাল বাংলাদেশ রিপোর্ট): একসময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লম্বা চুলে ব্রাশ চালাত আট বছরের শামা তুবাইলি। এখন আয়নায় তাকালেই তার চোখ ভরে আসে কান্নায়। মাথার ওপর ব্রাশ বোলাতেই হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমার চুল তো নেই! আমি আবার আমার চুল আঁচড়াতে চাই!”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে শামার জীবন ছিল অন্য আট-দশটা শিশুর মতোই। সে গাজার জাবালিয়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকত, বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। কিন্তু ওই দিনটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। হামাসের আকস্মিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। এরপর থেকেই তার জীবন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্দেশে শামার পরিবার প্রথমে দক্ষিণের রাফায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে আবার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় তারা। একের পর এক বোমা হামলা, চারপাশের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপ—এসব দেখতে দেখতে সে যেন ধীরে ধীরে নিজের ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে।
চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, শামার চুল পড়ার কারণ হলো ‘নার্ভাস শক’—মানসিক আঘাতের কারণে তার শরীর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের আগস্টে যখন রাফায় তাদের প্রতিবেশীর বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলা হয়, তখন থেকেই তার চুল পড়তে শুরু করে। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অ্যালোপেসিয়া’।
শামা প্রায়ই তার মা ওম-মোহাম্মদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “মা, আমি ক্লান্ত। মরে যেতে চাই। আমার চুল কেন গজাচ্ছে না?” তার মনে হয়, সে আজীবন টাক থাকবে। কখনো কখনো সে এমন কথাও বলে, যা শুনলে বুক ফেটে যায়, “আমি স্বর্গে যেতে চাই, সেখানে গিয়ে আমার চুল গজাবে।”
এই অবস্থা শুধু শামার একার নয়। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, গাজার প্রায় ১২ লাখ শিশুরই মানসিক সহায়তা প্রয়োজন। একটি প্রজন্ম ভয়, ক্ষুধা আর দুঃস্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছে। গাজা নিয়ে ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ শিশু মনে করে, তারা যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে। ৪৯ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা বেঁচে থাকার ইচ্ছা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে।
শামার চুল নেই, তার শৈশবও নেই। বাইরে বের হলে অন্য শিশুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, তাই সে সবসময় মাথায় গোলাপি ব্যান্ডানা পরে থাকে। একসময় যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ভালোবাসত, এখন সেই আয়নাই তার কাছে এক নির্মম সত্য তুলে ধরে—একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুর প্রতিচ্ছবি।
গাজার যুদ্ধ শুধু ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে না, কেড়ে নিচ্ছে একেকটি শিশুর স্বপ্ন, তাদের শৈশব, এমনকি তাদের শরীরের অংশও। শামার চুল ফিরে আসবে কি না, এই যুদ্ধ শেষ হবে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। শুধু জানা যায়, যুদ্ধ শুধু মানুষ মারে না, সে মেরে ফেলে শিশুর শৈশবও।