অর্থ-বানিজ্য ডেস্ক, ২৭মার্চ ২০২৫ইং (ডিজিটাল বাংলাদেশ রিপোর্ট): আগামী মাস থেকে দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপির নতুন নীতিমালা কার্যকর হতে যাচ্ছে, যা ঋণশ্রেণীকরণের সময়সীমাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনবে। নতুন নিয়ম অনুসারে, কোনো ঋণ তিন মাস অনাদায়ি থাকলেই তা নিম্নমানের, ছয় মাস অনাদায়ি থাকলে সন্দেহজনক এবং এক বছর অনাদায়ি থাকলে ক্ষতিজনক ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ অনাদায়ি থাকার সর্বোচ্চ সীমা দুই বছর পর্যন্ত ছিল, যা নতুন নিয়মে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতিমালা কার্যকর হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নতুন নীতিমালার কার্যকারিতা ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ডলার বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ঋণ পরিশোধে সক্ষম হচ্ছে না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) গভর্নরকে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে, নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পগুলোরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
তেল মিল মালিকদের সংগঠনও তাদের শঙ্কার কথা জানিয়েছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৫০ বছরে কখনো ঋণখেলাপি হয়নি, এমনকি সুদ মওকুফের আবেদনও করেনি। তবে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় নতুন ঋণশ্রেণীকরণ নীতিমালা কার্যকর হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই খেলাপি হয়ে পড়বে, যা দেশের শিল্প খাতের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নতুন নিয়ম অনুসারে, সব ধরনের ঋণ নির্ধারিত সময়ের পরের দিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। একই সঙ্গে ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হারও বাড়ানো হয়েছে। নিয়মিত ঋণের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ, ‘স্পেশাল মেনশন’ ঋণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ এবং খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। এই পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার বাড়ার ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতি না হলে নতুন ঋণশ্রেণীকরণ নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হতে পারে। ফলে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী এই নীতিমালার বাস্তবায়ন কিছুটা সময় পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।